মর্নিং ভিউ :– বড়মা — বড়মা মানেই একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোটি কোটি মানুষের কন্ঠস্বর এবং ঢাক,ঢোল,করতালের মিশ্র আওয়াজ | বড়মা মানেই লক্ষ ,লক্ষ মানুষের ঢল, বড়মা মানেই এপার বাংলা-ওপার বাংলার শ্রদ্ধান্বিত ব্যাকুলতা | বড়মা মানেই ধর্মক্ষেত্রে দাবী আদায়ের আন্দোলন,অনশন | বড়মা মানেই মতুয়া মহা সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব আদায়ের সূদীর্ঘ লড়াই | এবার প্রশ্ন আসছে —-কে এই বড়মা ?
1919 সালের 25 সেপ্টেম্বর পূর্ব বঙ্গের বরিশাল জেলার জব্দকাঠি গ্রামে জন্ম হয় এক বালিকার |মা,বাবা নাম রাখেন বীনাপানী | ক্রমে বাবা -মায়ের আদর্শে লালিত হয়ে বড় হতে থাকে বীনাপানী |তবে তখনকার সামাজিক নিয়মানুসারেই খুবই অল্প বয়সে ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি গ্রামে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় |ঠাকুর পরিবারের নিয়ম কানুনের সাথে তিনি নিজেকে ওতোপ্রতোভাবেই মানিয়ে নিয়ে পথ চলতে শুরু করেন |এই ঠাকুর পরিবার কৃষিভিত্তিক হওয়ায় তখনকার সমাজ ব্যবস্থা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী এই পরিবারের অন্যতম সন্তান হরিচাঁদ ঠাকুর সেখানে প্রবর্তন করেছিলেন বৈষ্ণব ধর্মকে | পরবর্তীতে বংশ পরিক্রমে এই বৈষ্ণব ধর্ম সমগ্র বাংলা জুড়ে এক বিপূল সংখ্যায় পুঞ্জিভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে | পরবর্তীকালে এই ধর্মকে হরিচাঁদ ঠাকুরের সন্তান গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া সম্প্রদায় নামে বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন করে তোলেন | আর সেই বিপূল সংগঠনকেই পরবর্তীতে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর এবং বীনাপানী দেবীর যৌথ উদ্দোগে বিস্তৃত করেন |
কিন্তু দেশভাগের পরেই বীনাপানী দেবী স্বামীর হাত ধরে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় চলে এসে বর্তমানের ঠাকুরনগরে বসতি স্থাপন করেন এবং এই বৈষ্ণব ধর্মকে বিষদাকারে সাংগঠনিক রূপে সজ্জিত করেন | দেশভাগের পর তাই ঠাকুরনগরই হয়ে ওঠে কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস ও ঈশ্বরপ্রীতির শ্রেষ্ঠ ধাম |কোটি কোটি মানুষের ধর্মক্ষেত্রে দাবী আদায়ের আন্দোলন যুক্ত হয় মতুয়া মহা সংগঠনের অন্দরমহলে | আর স্বাভাবিক ভাবেই অধিকার আদায়,দাবী আদায়-এর মাধ্যমেই ঠাকুর পরিবারে ঢুকে পড়ে রাজনীতির ছায়া | যদিও রাজনীতির প্রবেশাধিকার অনেক আগে থেকেই হয়,স্বামীর হাত ধরে।
1946 সালে এবং গণপরিষদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন পি,আর,ঠাকুর | 1952 সালে কংগ্রেসের সাংসদ নির্বাচিত হয়ে হাঁসখালির বিধায়কও হয়েছিলেন পি,আর,ঠাকুর | এসময় স্বামীকে বিভিন্নভাবেই রাজনীতিতে সাহায্য করেন বীনাপানীদেবী |
পি,আর ঠাকুরের জীবণাবসানের পরে বরনাপানীদেবী নিজেই বৈষ্ণব ধর্মের যাবতীয় দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন |নাগরিকত্বের দাবী , ধর্মক্ষেত্রের দাবী,পুনর্বাসনের দাবী তথা মতুয়া সংগঠনের দাবীতে বার বার ছুটে গিয়ে ধর্না দিয়েছেন মেট্রো চ্যানেলে,কখনও ঠাকুরনগরে |অনশনে বসেছেন নিজেই নাগরিত্ব আদায়ের দাবীতে |বাম আমলে সেই দাবীর আশ্বাস পেলেও তা কার্যকর হয়নি | বর্তমান মূখ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় এলে রাজনীতির বিশেষ প্রভাব পড়ে এই ঠাকুর পরিবারে তথা মতুয়া সম্প্রদায়ে| ঠাকুরবাড়ীর বিষেশ পরিবর্তন চমকে দেয় দেশবাসীকে | আর এই রাজনীতির কারনেই ঠাকুর পরিবারে ফাটল ধরে |মূখ্যমন্ত্রী বীনাপানীদেবীর আশীর্বাদ গ্রহণে তাঁর বাড়ীতে পা রাখেন কয়েকবার |এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর আশীর্বাদ গ্রহন করেন তাঁর বাসভবনে এসে |বীনাপানীদেবী এখন কোটি কোটি মানুষের বড়মা হিসেবেই বিশেষ পরিচিতা |
গত 2018 সালে বড়মা ওরফে বীনাপানীদেবীর জন্মদিন মহা ধুমধামের সাথে পালন করেন রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব | পালন করা হল বড়মা-এর শতবর্ষ জন্মদিন |
2019 ,5 মার্চ মতুয়া সম্প্রদায়ের তথা সমগ্র দেশবাসীর বড়মা — শতবর্ষের পরমায়ু মাথায় নিয়ে চলে গেলেন বৈকুন্ঠধামে | তিনি গত হওয়ার বেশকিছুদিন আগেই শারীরিক অসুস্থতার কারণেই চলাফেরা বন্ধ করেন | শেষ হল জীবনের আরও একটি অধ্যায় | তাই এপার বসংলা-ওপার বাংলার কোটি কোটি মানুষ আজ তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় মূহ্যমান |
রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে সাধারণ জনগন ও মতুয়া মহাসম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা ও পুষ্পমাল্যে সজ্জিত করে শোকার্ত মনেই শেষ বিদায় দেওয়া হয় ঠাকুরনগর এর মতুয়া মহা ধামে |